(৯৩৫ হিজরি বর্ষ) ১৫২৮ সাল মুসলিম সালতানাতের দ্বায়িত্বে মুঘল সম্রাট বাবর মনের আকাঙ্খা এক আল্লাহর ইবাদতগাহ নির্মান করবেন। ইচ্ছা অনুযায়ী মাসজীদ নির্মানের জন্য যায়গা নির্বাচন করলেন বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের, ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলকে। মসজিদ নির্মানের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত্ব অর্পিত হলো সেনাপতি মীর বাকীর উপর। তিনি দ্বায়িত্বের সর্বোচ্চ পারাকাষ্ঠা দিয়ে কাজে মনোযোগদ দিলেন। মাসজীদের কাজ শেষে মাসজীদটি সম্রাটের নামেই (বাবরি মাসজীদ )প্রসিদ্ধি পেতেথাকে । সেনাপতি মীর বাকি রাজ্যের সেরা স্থাপত্যশিল্পিদের নিয়োগদিয়ে সম্রাটের রুচিশীলতাকে খুব সুন্দরভাবেই মাসজীদের কারুকাজের মাঝে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বাবরি মসজিদকে অনেকটা জানপুরের সুলতানি স্থাপত্য আদলে গড়ে তোলাহয়। পশ্চিম দিক থেকে দেখলে জানপুরের আতালা মসজিদ এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনেহতো।[১২]
বাবরি মসজিদ ছিল তার সংরক্ষিত স্থাপত্য ও স্বতন্ত্র গঠনশৈলীর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । মসজিদটি সম্রাট আকবর দ্বারা গৃহীত ইন্দো-ইসলামী গঠনশৈলীর প্রতীক ছিল।আধুনিক স্থপতিদের মতে বাবরি মসজিদের চিত্তাকর্ষক স্বনবিদ্যার কারণ হল মসজিদটির মিহরাব পার্শ্ববর্তী দেয়ালগুলিতে বিভিন্ন খাঁজ যা অনুনাদক হিসাবে কাজ করত। এই নকশা মেহরাবে অবস্থিত ইমামের কথা (মাসজীদের) সবাইকে শুনতে সাহায্য করত। এছাড়াও বাবরি মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বেলেপাথর অনুনাদের কাজ করে যা মসজিদটির শব্দ-নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করত। কালের পরিক্রমাপেড়িয়ে মোগল সম্রাজ্য ও মুসলিম শাসনের অবসান ও ঘটে সাধীনতার সূর্যাস্তের সাথে অবসান ঘটে বছরের মুসলিমদের ইনসাফপূর্ণ গৌরব-উজ্জল শাসন ব্যবস্থার ।
এর পর ইংরেজদের ১৯০ বছরের শোষণ ঔপনিবেশিকতার যাতাকলে পিষ্ঠহয়ে বহু মানুষ জীবন দিতেহয় যার বড় অংশ ছিল মুসলিম নাগরিক । ১৭৫৭-১৯৪৭ পর্যন্ত কোটি মুসলমানের আত্মত্যাগ ৫ লক্ষ মুসলমানের (ফাসি)জীবন দিয়ে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে পারলেও ইংরেজদের দালালি করা কট্টর হিন্দুত্ববাদিদের নূতন ষড়যন্ত্রের নিশানাহয় ভারতবর্ষের ইসলাম ও মুসলমান। ১৯ শতকের দিকে এসে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাবাধিয়ে মুসলিমদের ভারত থেকে বিতারিত করে ভারত একক হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে দাড়করানোর ছক আকে। সেই ছকের অন্যতম এজেন্ডা হলো ৭০০ বছরধরে তিলতিলে মুসলিম শাসকদের গড়েতোলা এই সম্রাজ্য থেকে তাদের ইতিহাস ও নিদর্শণ মুছেফেলা, হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাধানো ,সাধারণ হিন্দুদের মনে মুসলিম বিদ্দ্বেষী উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ রোপন করা।
বাবরি মাসজীদ তৈরিকরা থেকে শুরুকরে তাদের শতশত বছর কোনো আপত্তি নাথাকলেও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের-ই-অংশ হিসেবে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদি কিছু সংগঠন ১৯ শতকের দিকে একটি কাল্পনিক চটি বইয়ের উপরে ভিত্তিকরে নূতন বিতর্কের জন্ম দেয়। যে বাবরি মাসজীদ মূলত রামমন্দির ভেঙে তারউপরে তৈরি করাহয়েছে এবং এ বাবরি মসজিদ যে স্থানে অবস্থিত ছিল সেটাইছিল রামের জন্মস্থান। (যদিও ভারতের বহু ইতিহাসবিদের মতে রামের ভারতেই জন্মহয়নি।)
এর জের ধরে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একাধিক কলহের ঘটনা ঘটে এবং পাল্টাপাল্টি আদালতে মামলা দায়ের চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালে উগ্রহিন্দুত্ববাদীরা হিন্দু মহাসভার সাথে জোট বেধে গোপনে রামের একটি মুর্তি মসজিদের অভ্যন্তরে রেখে দেয়। এরপরই সরকার দাঙ্গা ঠেকানোর নামে পুরো মসজিদকে সিলগালা করে দেয়। হিন্দু-মুসলিম উভয়ই সে স্থানে প্রবেশাধিকার পেতে আদালতে মামলা করে।
উত্তরপ্রদেশের তদানিন্তন মূখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং, বিজেপি নেতা বাজপেয়ী, এল কে আদভানি, জোশি,উমাভারতি এবং বিজয় রাজে স্কিন্দিয়া্রের প্রকাশ্য ইন্ধন ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিরব সমর্থনে উগ্র হিন্দুত্ববাদি সন্ত্রাসীগোষ্ঠি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং তাদের সহযোগী সংগঠনের জঙ্গিরা ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দিয়ে দাঙ্গা সৃষ্টিকরে। যার ফলে পুরো ভারত জুড়েই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এই দাঙ্গা পুরো ভারতজুড়ে প্রায় ২০০০ মানুষকে গণহত্যা করাহয়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম। অসংখ্য মুসলিম মা-বোনের সম্ভ্রম লুটকরাহয়,অসংখ্য বাড়ি-ঘরে অগ্নি সংগযোগ ও লুটতরাজ চালানোহয়।
বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের অজস্র প্রতিবাদ সত্যেও এপর্যন্ত এই গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। পরবর্তিতে ভারতের প্রত্নতত্ব বিভাগ খনন কাজ চালিয়ে দাবিকরে বাবরি মাসজীদের নিচে্ তারা স্থাপনার অস্তিত্ব পেয়েছে কিন্তু সামান্যতম বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দিতে পারেনি যে, সেই স্থাপনাটিই রাম মন্দিরের অংশ।
এবার আসি রায়ের ব্যাপারে- ২০১০ সালে এলাহাবাদ উচ্চ আদালত এক রায়ে আদেশ দিয়েছিল, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখাড়া, রামলালার মধ্যে জমি সমান ভাগে করে দেয়া হোক। এর ফলে হিন্দুরা পায় জমির তিন ভাগের দুই ভাগ। মুসলিমরা এক ভাগ। এর বিরুদ্ধে সব পক্ষই উচ্চ আদালতে আপীল করে।
৯ নভেম্বর ২০১৯ সালে উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায়কে রদ করে ঘোষণা দেয় ২.৭৭ একরের পুরো জমিই এমন একটি ট্রাস্টকে দিতে হবে, যারা হিন্দু মন্দির নির্মাণ করবে। একই সাথে আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয় সুন্নী ওয়াকফ বোর্ডকে বিকল্প ৫ একর জমি দিতে হবে মসজির নির্মাণের জন্য এবং সে জমি অযোধ্যায়ই হতে হবে।
কি হাস্যকর ব্যাপার! মুসলিমদের মাসজীদকে শহীদকরে তাদের ওয়াকফকৃত ২.৭৭ জমি দখল করে তা উগ্রহিন্দুদের মন্দিরের জন্য প্রদানকরে আবার মুসলিমদের অন্য স্থানে ৫ একর জমি ভিক্ষা প্রদান করছে।
একটি দেশের আদালত কতটা অন্ধ,বেহায়া হলে শতভাগ বিশুদ্ধ দলীল থাকার পরেও একটি চটি বইয়ের কল্পনাকে ভিত্তিকরে বিশ্বঐতিহ্যের নিদর্শণ প্রাচীন মাসজীদের স্থানে একটি মন্দির নির্মানের নির্দেশ দিতেপারে? একটি জাতি কতটা অধপতিতহলে একজন দাঙ্গাবাজ গণহত্যায় অভিযুক্তকে রাষ্ট্রের প্রধান পদে বসাতে পারে?
বেদনা নিয়ে বলতেহয় আজ (৫ই আগষ্ট,২০২০) যেই দাঙ্গাবাজ খুনির প্রচ্ছন্ন নেতৃত্বে গুজরাটে গণহত্যা চালানো হয় সেই দাঙ্গাবাজের হাতধরেই মাসজীদের উপর রক্তেরঞ্জিত মন্দিরের ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে।
জাতীরকাছে প্রশ্ন যারা সুলতান মুহাম্মাদ আল- ফাতিহ’র ক্রয় করে ওয়াকফকৃত জায়গা ও ভবনে সংস্কারকৃত মাসজীদকে তার নিজরূপে ফিরানোয় মানবতার বেলুন উড়াতে শুরুকরেছিলেন তিনাদের মানবতা কি আজ জাগ্রত হবে? নাকি আপনাদের মানবতার ফাকাআওয়াজ কেবল মুসলিমদের জন্যই বরাদ্ধ!
১২৩৬ সালে ক্যাসলের রাজা তৃতীয় ফার্ডিনান্দ ও রাণী ইসাবেলা মুসলমানদের সাথে চুক্তিকরে যে শহর হস্তান্তর করলে মুসলিমদের নিরাপত্তা দিবে এবং মাসজীদ মাদ্রাসা সহ মুসলিম স্থাপনাগুলো সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু চুক্তির সকল শর্ত ভঙ্গকরে নির্বিচারে মুসলিমদের গণহত্যা করে স্পেন দখল করে ঐতিহাসিক করডোভা মসজিদকে রোমান ক্যাথলিক গির্জায় রুপান্তরিত করে৷ আজো সেখানে ক্রুশ টানিয়ে রাখা হয়েছে৷ নামাজ পড়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এমনকি কেউ যেন রুকুও না করতে পারে, সেজন্য বিভিন্ন স্থানে সিকিরিউটি লোক রাখা হয়েছে৷ ২০১০ সালে এক দল মুসলিম পর্যটক শুধু রুকু করতে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন৷
১৮৭১ সালে গ্রীসের আগ্রোসে বশীর আগা মাসজীদকে গীর্জা বানানো হয়, মুসলিম জাতীর খেলাফত ব্যবস্থা ধ্বংসকরে ১৯২৫ সালে উসমানী খিলাফত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া গ্রীসেই ফাযিল আহমেদ পাশা মাসজীদকে গীর্জা বানানোহয়,১৮৯৭ সালে বুলগেরিয়ার সোফিয়াতে ব্লাক মাসজীদকে দখল করে গীর্জা বানানো হয়। এর বাইরে ইতালি, গ্রীস স্পেনের সহ শুধু ইউরোপেই ১০ হাজার মাসজীদকে গীর্জা, ক্লাব,সরাবখানায়, এমনকি শুকরের গোয়ালে পরিণত করেছে। কিন্তু তা নিয়ে আমরা বরাবর লক্ষ্য করেছি কথিত মানবতাবাদীরা চোখের মধ্যে কালো চশমা দিয়ে মুখে কুলুপ এটে আছেন। এ ব্যপারে তাদের চেতনা কখোনোই উদয় হয়না। মাজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক উক্তি” মুসলিমদের মানবাধিকার থাকতে নেই” কি বাবরির ট্রজেডির মধ্যদিয়ে আরেকবার প্রমাণিত হচ্ছে! আরো একবারকি প্রমাণিত হচ্ছে মুসলিম বিদ্বেষী হওয়াই নোবেল প্রপ্তির প্রধান মাপকাঠি!
সবশেষে ইতিহসের একজন ছাত্র হিসেবে বলতে চাই এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মত খানায়ে কা’বার অভ্যন্তরে মুশরিকদের জোরকরে চাপিয়েদেয়া ৩৬০ টি মূর্তি যেভাবে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হয়ে কা’বা তার স্বরূপে ফিরে এসেছে। ঠিক একদিন আবারো বাবরি মাসজীদের আপন স্থান থেকে মিনারগজিয়ে উঠবে। মুয়াজ্জিন দরাজ কন্ঠে আল্লাহুআকবার ধ্বনি হাকবে। ইংশাআল্লাহ। সে দিনের অপেক্ষায় ………………।