রোজা ও আধুনিক বিজ্ঞান
হাফজ ডা: মো: আনোয়ার হোসেন
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, যার প্রতিটি বিধান মানবজাতির জন্য কল্যাণকর। রোজা হল ইসলামের একটি মৌলিক ভিত্তি। রোজা শুধু আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জুনের জন্য উপকারিতা নয় বরং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। চিকিৎসা বিজ্ঞান রোজার ব্যবহারিক তাৎপর্য উপলব্ধি করে তার সত্যতা প্রমাণ করেছে।
প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরের বিভিন্ন কোষ মরে যায়, মৃত্যু এই কোষগুলো কোষের অভ্যন্তরে লাইসোজোম নামের একটি বিশেষ অঙ্গে জমা হতে থাকে। একইভাবে জমা হয় মৃত্যু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস। রোজার সময় খাবার গ্রহণ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকে এ সময় শরীরের কোষগুলো বাহির থেকে কোন খাবার না পেয়ে নিজেই নিজের ক্ষয়প্রাপ্ত এবং দুর্বল কোষগুলো খেয়ে ফেলে। এই প্রক্রিয়াটা যখন ২৫ -২৮ দিন চলতে থাকে এবং ক্ষয় প্রাপ্ত ও কার্যক্ষম নয় এমন কোষগুলো রিপেয়ার হয়ে যায়। যার ফলে শরীরের বর্জ্য ব্যবহৃত হয়ে শরীরকে করে দূষণমুক্ত। শরীরের এই প্রক্রিয়াকে বলে অটোফেজি।
এছাড়াও রোজা রাখার মাধ্যমে খুব সহজেই অটোফেজি হয় যেখানে তৈরি হয় নাইট্রিক অক্সাইড যেটি দেহকোষকে পুনর্জীবিত করে বাড়িয়ে দেয় কোষের আয়ু এবং এটি এন্টি এজিং বা বার্ধক্যরোধক হিসেবে কাজ করে।
বিখ্যাত জার্মান গবেষক ও বিজ্ঞানী ওশিনরি ওসুমি ( Yoshinori ohsumi) তার বিখ্যাত অটোফেজির তথ্য দিয়ে ২০১৬ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।
তিনি বলেন মুসলমান যেটাকে রোজা বলে আমি সেটাকে বলি অটোফেজি।
দীর্ঘদিন একইভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরে তা অতিরিক্ত মেদ হিসাবে জমা থাকে। সেই সঙ্গে বাড়ে ক্ষতিকারক টক্সিন এর মাত্রাও। রোজা বা উপবাস করলে শরীরের মধ্যকার শর্করা প্রোটিন ও চর্বিতীয় পদার্থ গুলো পাচিত হয় ফলে কোষ গুলোর কোন ক্ষতি না হয়ে বরং পুষ্টি বিধান হয়। এছাড়া এ সময় পাকস্থলী, অন্তনালী যকৃত সহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পায়।
ক্যালোরি রেস্ট্রিকশন এর উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, রোজা বা উপবাসের মাধ্যমে দিনের গৃহীত ক্যালরির পরিমাণ কমিয়ে আনলে তার শারীরিক স্থায়িত্ব বাড়ায় এবং বেশ কিছু জটিল অসুখের ফলে সৃষ্ট জটিলতা কমিয়ে আনে। রোজা রাখলে খারাপ কোলেস্টেরল LDL বাড়ে ৮% ট্রাই এসাইল গ্লিসারল (TG) বাড়ে ৩০% এবং ভালো কোলেস্টেরল
অর্থাৎ HDL বাড়ে ১৪.৩%। ফলে হার্ট অ্যাটাক এর ঝুঁকি কমায় এছাড়াও ঝুঁকি কমায় রক্তনালীতে চর্বি জমে সৃষ্ট অ্যথোরোসক্লেরোসিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ সহ অন্যান্য নিউরো ডিজেনারেটিভ ডিসঅর্ডার।
রোজার মাধ্যমে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিম্বিক সিস্টেম এর উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ায় অর্থাৎ রোজা শারীরিক সক্ষমতা তৈরীর পাশাপাশি এনে দেয় মানসিক প্রশান্তিও। এটার মূল কারণ হলো ব্রেন থেকে নিঃসৃত পদার্থ BDNF (Brain-derived neurotrophic factors) পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক রোগ দূর করে দেয়।
আমরা অনেকেই মনে করি রোজা রাখলে পেপটিক আলসার বেড়ে যায় এটা সম্পূর্ণ ভুল বরং পেকটিক আলসার রোজার কারণে তাড়াতাড়ি ভালো হয়। রোজার কারণে পাকস্থলী খাদ্য মুক্ত থাকে এ সময় তার ক্ষয় পূরণ ও পুনর্গঠণের কাজ শুরু হয়। নিয়মিত পেট খালি রাখলে ও নিয়মিত আহার করলে পাকস্থলীতে এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় যাতে পাকস্থলী আলসার বা ক্ষত শুকাতে সহায়ক হয়। দেখা যায় রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না উপবাস থাকছে রোগটি।
ডাক্তার ব্লিভ তার পেপটিক আলসার নামক গবেষণামূলক বইয়ে উল্লেখ করেন- মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পেপটিক আলসার নামক রোগের প্রকোপ অনেক কম। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন দীর্ঘ এক মাসের রোজাকে।
আমরা অনেকেই মনে করি রোজা রাখার ফলে শরীর অনেক ধরনের ক্ষতি হয় যেমন ওজন কমে যায়, দুর্বলতা বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি।
কায়রো থেকে প্রকাশিত Science calls for fasting গ্রন্হে পাওয়া যায় – The power of endurance fasting condition are remarkable. after a fast properly taken the body is literly born a fresh
অর্থাৎ রোজা রাখা অবস্থায় শরীরের ক্ষমতা ও সহ্য শক্তি উল্লেখযোগ্য, সঠিকভাবে রোজা পালনের পর শরীর প্রকৃত পক্ষে নতুন সজীবতা লাভ করে
রোজার মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ না করায় আলফা-১ ও গামা নামক প্রোটিন বৃদ্ধি পায়। এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
রোজা ওজন কমাতে সাহায্য করে। শরীরে যাদের বাড়তি ওজন, তারা এই সময়ে বিশেষভাবে উপকৃত হয়ে থাকেন। যেহেতু রমজানুল মোবারকের পুরো মাসজুড়ে রোজাদার ব্যক্তিগণ খাদ্যাভ্যাসে নির্দিষ্ট নিয়ম এবং রুটিন মেনে চলে।
রমজানে রোজা রাখার অন্যতম সুবিধা হলো এটি রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। রোজা গ্লুকোজকে ভেঙে দেয়, যাতে শরীর শক্তি পেতে পারে যা ইনসুলিনের উৎপাদন হ্রাস করে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। রোজার সময় বিপাকের হারও হ্রাস পায়। অ্যাড্রিনালিন এবং ননঅ্যাড্রিনালিন হরমোনগুলির ক্ষরণও হ্রাস পায়; এটি বিপাকের হারকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে, যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করার পাশাপাশি আত্মনিয়ন্ত্রনের মানসিকতার শিক্ষা দেয় পবিত্র মাহে রমজান। রমজানের সময় রোজার এটি অন্যতম বিশেষ একটি শিক্ষা- আপনার শরীরের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্বেও খাদ্য এবং পানীয় না দিয়ে কীভাবে মনের এই চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন তা শেখার জন্য প্রস্তুত করে। এই প্রক্রিয়াতে, মস্তিষ্ক সেই অবস্থার সাথে মানিয়ে নেয় এবং কীভাবে আরও ধৈর্যশীল হতে হয় তা শেখায়।
Stamford University ‘ র একটি গবেষণায় দেখা গেছে যেখানে ১৫৪৮ জন ছাত্রছাত্রীর উপর ৯০ বছর পর্যবেক্ষণ করা হয়- তিনটি কাজ করলে মানুষ বেশি দিন বাঁচতে পারে এবং ভালো করে বাঁচে। সেই তিনটি কাজেই রোজার সাথে সম্পর্কিত আর তা হল –
Social activity ( সামাজিক কার্যক্রম)
Spirituality ( আধ্যাত্মিকতা)
Prayer ( প্রার্থনা)
রাশিয়ার একটি গবেষণায় দেখা গেছে তিনটি কাজ করলে শরীরের বিষাক্ত দ্রব্যাদি বের করে হয়ে যায়, এবং বার্ধক্যকে থামিয়ে দেয়। আর তা হল –
– অধিক পরিশ্রম করা
– অধিক পরিমাণে ব্যায়াম করা
– প্রত্যেক মাসে একদিন উপবাস থাকা
খ্যাতনামা টিভি জার্নালিস্ট মাইকেল মজলি যিনি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক ডকুমেন্টারির একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক তিনি একটি গবেষণায় দেখেছেন- রোজা বা উপবাসে পোস্টের সহ অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি ৫০%কমায়। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি বাড়ায় ক্যান্সার রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষের বৃদ্ধিকে প্রতিহত করে।
ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য ধর্মেও বিভিন্ন ধরনের উপবাস থাকার ধর্মীয় রীতির প্রচলন রয়েছে যেমন খ্রিস্টানদের ক্যালরী রেস্ট্রিক্টেড ফাস্টিং ( দৈনন্দিন গৃহীত খাবারের ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা হয়) অল্টারনেট ডে ফাস্টিং (একদিন পরপর ২৪ ঘন্টার জন্য পানি ব্যতীত সকল ধরনের খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয়)। অথচ ইসলাম হাজার বছর ধরে রোজা পালিত হয়ে আসছে। রোজা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটায়। আসুন আমরা সবাই রোজা পালন করি এবং মুক্তির পথ সহজ করি। আমিন।
লেখক: রেসিডেন্স ( জেনারেল সার্জারী বিভাগ)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।